পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নে প্রতিদিন নিরাপদ
পানি পানের গুরুত্ব
কৃষিবিদ প্রিন্স বিশ্বাস
কোন জাতির পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নের সাথে সেই জাতির মেধার ও কর্মদক্ষতার উন্নয়ন জড়িত। পুষ্টিগত অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন’ মর্মে উল্লেখ করা হয়।
পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়নের প্রথম শর্তই হলো খাদ্যের সহজলভ্যতা তথা খাদ্য সকল পেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। এক সময়কার আমদানি নির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে কোন কোন ক্ষেত্রে আজ রপ্তানিমুখী। বর্তমান উৎপাদিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের সকল পেশার মানুষের মধ্যে সহজলভ্যতা, ক্রয়ক্ষমতা ও সমবন্টনের অভাবে সুষম খাদ্যাভাস গড়ে ওঠেনি। সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যে পুষ্টি জ্ঞানের অভাব, অজ্ঞতা বা অবহেলার কারণে গ্রহণকৃত খাদ্য দ্রব্য থেকেও যে পরিমাণ পুষ্টি উপাদান পাওয়ার কথা তা থেকেও মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ডিমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেল্থ সার্ভে (ইউঐঝ)-২০২২ ও ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন অনুযায়ী, এখনো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মধ্যে ২৪ শতাংশ খর্বকার, ১১ শতাংশ কৃশকায় এবং ২২ শতাংশ বয়সের তুলনায় কম ওজন। ৫৬ শতাংশ নারী অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ করছে এবং প্রজনন বয়সী প্রায় ৫০ শতাংশ নারী বিভিন্ন রকমের পুষ্টি উপাদানের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে।
বাংলাদেশের খানার আয় ও ব্যয় জরিপ (ঐওঊঝ)-২০২২ অনুযায়ী একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ৩৪.১ গ্রাম, মাংস ৪০ গ্রাম, মাছ ৬৭.৮ গ্রাম, সবজি ২০১.৯ গ্রাম এবং ফলমূল ৯৫.৪ গ্রাম গ্রহণ করে থাকেন। অপরদিকে বছরে ডিম গ্রহণ করে থাকেন গড়ে ১০৪.২৩টি। যা কোন কোন ক্ষেত্রে খাদ্য শ্রেণিগুলোর ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অর্জিত হয়নি। আবার দেশব্যাপী সকল বয়সী ও শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে মোট প্রাপ্যতা অনুযায়ী সমভাবে বন্টনও হয়নি।
যেখানে একজন মানুষের মোট ক্যালরির ৫৫-৬০ শতাংশ দানাদার খাদ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত সেখানে বেশির ভাগ মানুষ এখনো ৭০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ক্যালরি ভাত ও রুটি থেকে গ্রহণ করেন। অপরদিকে অপর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাণিজ আমিষ, ফল, শাকসবজি গ্রহণ করার ফলে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ লুক্কায়িত ক্ষুধা বা ভিটামিন এ, ফলিক এসিড, আয়োডিন, আয়রন, জিংক, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবে ভুগছেন। ফলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর খর্বতা, কৃশকায়, কম ওজন প্রভৃতির মতো গুরুতর ও পুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা বিদ্যমান। এর ফলে শিশুর সুস্বাস্থ্য, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে চাহিদার ভিত্তিতে পূর্ণ বয়স্ক মানুষের কার্যক্ষমতা বাড়ছে না। পাশাপাশি পুষ্টি সংশ্লিষ্ট অসংক্রামক ব্যাধি ও শারীরিক সমস্যা যেমন অতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও লিভারের মতো রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা (জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী)
পরিশ্রমভেদে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ২৭০-৪২০ গ্রাম (সর্বোচ্চ) এর সমপরিমাণ চাল বা গম মাঝারি আকারের ১-৪ টুকরো (এক টুকরো = ৫০ গ্রাম) মাছ/মাংস এবং ১ থেকে ২ কাপ ডাল (৩০-৬০ গ্রাম) জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েই নিশ্চিন্তে দৈনিক একটি ডিম খেতে পারবেন। অল্প পরিমাণে কাঁচা অথবা শুকনো ভাজা বিভিন্ন ধরণের বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবার লবণ ছাড়া সপ্তাহে চার বা পাঁচবার খাওয়া যেতে পারে।
মজবুত হাড় এবং দাঁতের জন্য ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস হিসেবে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ মি. লি. দুধ বা দুধজাতীয় পণ্য গ্রহণ করা উচিত। দুধ সহ্য না হলে দুধের পরিবর্তে দই বা সয়াদুধ গ্রহণ করা যেতে পারে। দইয়ে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া থাকে যা দেহের জন্য উপকারী এবং যা দুধের ল্যাকটোজ পরিপাক করতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন কমপক্ষে ২টি মৌসুমি ফল গ্রহণ করা উচিত। একটি লেবু জাতীয়, অন্যটি ভিটামিন এ এর উল্লেখযোগ্য উৎসগুলোর থেকে একটি। খাদ্য গ্রহণের পর আয়রনের পরিশোষণ বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল গ্রহণ প্রয়োজন। প্রতিদিন অন্তত ১০০ গ্রাম বা ১ আঁটি শাক এবং ২০০ গ্রাম বা ২ কাপ সবজি গ্রহণ করা উচিত।
দৈনিক ৩০ গ্রামের (সর্বোচ্চ ২ টেবিল চামচ) বেশী তেল গ্রহণ না করাই ভালো। হাইড্রোজেনেটেড তেল কিংবা মাখন, ঘি এর মতো সম্পৃক্ত চর্বির তুলনায় সরিষার তেল, সয়াবিন, রাইসব্রান প্রভৃতি উদ্ভিজ্জ তেল বেশি ভালো এবং স্বল্প পরিমাণে ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। প্রাকৃতিক সম্পৃক্ত চর্বি, যেমন মাখন, ঘি নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ব্যবহার অথবা প্রয়োজন হলে ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। খাবারের সাথে বাড়তি লবণ গ্রহণের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং দৈনিক গহণের পরিমান এক চা চামচের (৫ গ্রাম) মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। দৈনিক ২৫ গ্রাম বা ৫ চা চামচ-এর কম চিনি গ্রহণ করতে হবে। দৈনিক তরলের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ ও সুপেয় পানি পান করতে হবে।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি পানের নিয়মাবলী ও গুরুত্ব
পানি একটি অজৈব যৌগ রাসায়নিক পদার্থ। যা পৃথিবীর হাইড্রোস্ফিয়ারের প্রধান উপাদান এবং সমগ্র পরিচিত জীবনের অস্তিত্বের জন্য অত্যাবর্শকীয়।
এটি মানবদেহের একটি মুখ্য উপাদান এবং একটি অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি খাদ্য পরিপাক, পরিশোষণ, পরিবহন, বর্জ্য পদার্থ দূরীকরণ এবং শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন। নবজাতক যারা সঠিক নিয়মে মায়ের দুধ পান করে তাদের জন্য বাড়তি পানির প্রয়োজন হয় না। বাড়ন্ত ভ্রƒণ এবং অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডের চাহিদা পূরণ এবং এক্সট্রা সেলুলার ফ্লুইড বৃদ্ধির কারণে গর্ভবতী নারীর অতিরিক্ত পানি পানের প্রয়োজন হয়। মায়ের দুধের সাথে বেরিয়ে যাওয়া তরলের ঘাটতি পূরণের জন্য মাতৃদুগ্ধদানকারী নারীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করতে হবে।
আমাদের শরীরের মোট ওজনের ৭০% পরিমাণ পানি এবং রক্ত ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক শারীরিক তরলের উপাদানও পানি। শরীর থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই লিটার পানি বের হয়ে যায়। প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ১.৫-৩.৫ লিটার অর্থাৎ ৬-১৪ গ্লাস নিরাপদ পানি পান করা প্রয়োজন। নিরাপদ পানি বিষয়ে সন্দেহ থাকলে ফুটানো পানি পান করা যেতে পারে। কোমল পানীয় এবং কৃত্রিম জুসের পরিবর্তে ডাবের পানি অথবা টাটকা ফলের রস পান করা পুষ্টিসম্মত। তাজা ফলমূলের জুস পরিমিত পরিমাণে পান করতে হবে।
শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দিলে শরীর নিজে থেকে কিছু সংকেত দিয়ে জানিয়ে দেয়। জেনে নেয়া যাক যেসব লক্ষণ জানিয়ে দেয় শরীরে পানির ঘাটতি রয়েছে।
১) শরীরে পানির অভাবে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং ঠোঁট ফাটতে শুরু করে। হঠাৎ করে ত্বক রুক্ষ বোধ করতে শুরু করলে এবং ত্বকে ব্রণ ও চুলকানির সমস্যা দেখা দেয়।
২) পানির অভাবে প্রস্রাবের রং হলুদ হয়ে যায় ও প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং প্রস্রাব করার সময় জ্বালা বোধ হয়।
৩) পানির অভাবে শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি মুখে দুর্গন্ধও হয়। পানি মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণে লালা উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। যা নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
৪) ডিহাইড্রেশন অবস্থায় বারবার তৃষ্ণা অনুভব হয়। বার বার পানি খেলেও শরীরে পানি জমা থাকতে পারে না। সাধারণ পানির পরিবর্তে লেবু-পানি বা ইলেকট্রল দ্রবণযুক্ত পানি পান করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ডিহাইড্রেশনের সমস্যায় খুব বেশি খিদেও পায়।
৫) পানির অভাবে শরীরে অনেক সময় নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা দেখা যায়। এর ফলে কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ মনে আতঙ্ক জাগে বা মাথাব্যথা। সারাক্ষণ আলস্য ও ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও হতে পারে শরীরে পানির ঘাটতির কারণে।
৬) পানির অভাবে রক্ত স্বল্পতাও দেখা দেয়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পর্যাপ্ত রক্ত পৌঁছে দিতে হৃদযন্ত্রকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে হৃদ্যন্ত্র উপর চাপ পড়ে। হঠাৎ করে হৃদ্স্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়।
কেবল পান করার পানিই নিরাপদ হলেই হবে না। খাদ্য রন্ধন বা গ্রহণের পূর্বে খাদ্যদ্রব্য ভালভাবে নিরাপদ পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। রন্ধন ও খাবার পরিবেশন কাজে ব্যবহৃত বাসন পরিষ্কার করার কাজে ও রন্ধন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানিও অবশ্যই নিরাপদ হওয়া প্রয়োজন। কারণ এসব কাজে ব্যবহৃত পানির মাধ্যমে আমাদের দেহে বিভিন্ন রোগের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে এবং পানি বাহিত বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং দেশি ও আন্তর্জাতিক এনজিও/সংস্থার মিলিত কার্যক্রমের ফলেই বর্তমানে মানুষের মধ্যে পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিগত কয়েক বছরে জাতীয় পর্যায়ে অপুষ্টিজনিত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে পুষ্টিগত অবস্থার উন্নতি এবং নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে খাদ্যভিত্তিক পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির বাস্তবসম্মত ও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আর এর মধ্যদিয়েই দেশের পুষ্টিগত অবস্থার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (বারটান), মোবাইল: ০১৭২৮ ৩৩৫৯৩৩, ই-মেইল: princebiswas211@gmail.com